স্টাফ রিপোর্টার: হিমালয়ের কোল ঘেঁষা ও সমতলের চায়ের স্বর্গরাজ্য ক্ষ্যাত উত্তরের চায়ের জনপদ করতোয়া ভ্যালির চা অঞ্চল। ৯০ দশকের পর থেকে এখন পর্যন্ত ধীরে ধীরে পঞ্চগড় জেলায় চা আবাদ বিস্তৃত হয়েছে। সময়ে শ্রোতে এই চা বিস্তার লাভ করে পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, লালমনিরহাট ও রংপুর জেলাগুলোয়। প্রায় বিশ বছর পর সমতল ভূমিতে চা আবাদে চায়ের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠে এ অঞ্চল। শেষ টানা তিন বছর থেকে দেশের চা অঞ্চলের তিন ভ্যালি সুরমা ভ্যালি ( সিলেট অঞ্চল) হালদা ভ্যালি( চট্টগ্রাম অঞ্চল) ও করতোয়া ভ্যালি ( উত্তর অঞ্চল) এর মধ্যে উৎপাদনের ২য় স্থানে উঠে আসে পঞ্চগড়ের চা শিল্প। যা পর পর তিন বছর থেকে এ স্থান দখল করে আসছে। চলতি মৌসুম শেষে সমতলভূমিতে সবুজ চা পাতা ৮ কোটি ৬১ লক্ষ ৪৬ হাজার ৭ শত ০৪ কেজি উৎপাদিত হয়েছে। যার মেট চা (সিটিসি) এর মাধ্যমে ১ কোটি ৭৯ লক্ষ ৪৭ হাজার ২ শত ৩০ কেজি। এবং একই সময়ে ২০২২/২৩ মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে ১ লক্ষ ৬৫ হাজার ও ২০২১/২২ এ উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪৫ লক্ষ ৪০ হাজার কেজি। যা বাংলাদেশের জাতীয় উৎপাদনের ১৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
এদিকে পঞ্চগড়ের চায়ের উৎপাদনের কারণে ধ্বংসের পথে বাংলাদেশের চা ইন্ডাস্ট্রি। কিছু যত্রতত্র চা ফ্যাক্টরি দিয়ে নিম্নমানের কোয়ালিটির চা তৈরি ও চোরাই পথে চা বিক্রির কারণে হুমকিতে পড়েছে গোটা দেশের চা শিল্প। অনুসন্ধানে জানা যায়__ পঞ্চগড়ের উৎপাদিত চা উৎপাদন করে চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গলে চা ওয়্যারহাউজ এ পাঠানোর নাম করে ও একটা সিন্ডিকেট মহল তৈরি করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চোরা চালানের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীর হাতে চলে যায়। যার কারণে নিলাম মার্কেটে চা বিক্রয় হচ্ছে না, চা নিলামে বিক্রি হলে সরকার চায়ের উপর রাজস্ব পেয়ে থাকে। এছাড়া নিলাম সিস্টেমে কোয়ালিটি অনুযায়ী চায়ের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। কিন্তু কিছু অসাধু চা কারখানার মালিক রাতের আধারে সরাসরি চা কারখানা থেকে চোরাই পথে চা বিক্রির কারণে একদিকে যেমন সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। অপরদিকে মার্কেটের সাথে সমন্বয় করে চা বিক্রি করতে পারছে না শতভাগ নিলাম থেকে ক্রয় করা চা ব্যবসায়ীরা।
হুমকিতে বাংলাদেশের চা শিল্প
সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের চা শিল্প হুমকিতে পরার মূল কারণ হচ্ছে মার্কেট ট্রেন্ড ও সমন্বয় করে চা বিক্রি করতে না পারা। এছাড়া সমতলের চা ইন্ডাস্ট্রিস এখনও টেকসইমূলক শিল্পে পরিনত না হওয়া। নানা মূখি ঝামেলার সাথে চা কারখানাগুলো সঠিক পাইপলাইনে প্রবেশ না করা সহ বিভিন্ন কারনে থুবড়ানোর মত অবস্থা। ২০২৪/২৫ চা নিলাম বর্ষের মৌসুমের নিলামের শুরুতে বাংলাদেশ চা বোর্ড ও চা সেলস কমিটির সদস্যের সাথে যৌথ মিটিং করে চায়ের সর্বনিম্ন ফ্লোর প্রাইজ বেধে দেয় ১৬০ টাকা। যার ভ্যাট ও ট্যাক্স এ মূল্য গিয়ে দারায় ১৮৫ টাকারও বেশি। কিন্তু কিছু চোরাকারবারি চা কারখানার মালিক নিয়মবহির্ভূত করে ও সরকারের চোঁখ ফাঁকি দিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর মাধ্যমে ও কাভার্ডভ্যানে করে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় চা বিক্রি করে আসছে। মার্কেটের চাহিদা ও সরাকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার কারণে নিলাম থেকে যারা চা ক্রয় করে আসছে তারাও টিকে থাকতে পারছে না। এদিকে গত কয়েক বছর থেকে সিলেট অঞ্চলের অনেক চা বাগানের ম্যানেজার স্টাফদের বেতন সঠিক সময়ে প্রদান করতে পারছে না। সঠিক মত বেতন না দেওয়ার মূল কারণ তাদের উৎপাদনের খরচ অনুযায়ী চা বিক্রি হচ্ছে না। কারণ মার্কেটে কম দামে চা পাতা পাওয়া যায়। এছাড়া চা শ্রমিকদের সাপ্তাহিক তলব দিতে হিমশিম খাচ্ছে বেশিরভাগ কোম্পানিগুলো। করোনা মহামারির পর থেকে এ পর্যন্ত দফায় দফায় চা শ্রমিক, সংগঠন ও মালিকপক্ষ মিটিং করেও থেমে রাখতে পারছে না।

এর আগে সিলেট এর বাগান মালিকগণ সম্মিলিতভাবে সমস্যার কথা বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর মোঃ আশরাফুল ইসলাম এনডিসি, পিএসসি এর কাছে তুলে ধরেন, নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেট বেল্ট এর একজন বাগান মালিক বলেন__ আমরা কিছু বছর থেকে চা বাগানে লোকসান দিয়ে আসতেছি। এভাবে চলতে থাকলে আমরা ব্যাংক ঋণ দিতে পারব না। পঞ্চগড়ের চা চোরাই পথে আসর আগে আমাদের সব ঠিক ছিল, কিন্তু পঞ্চগড়ের চা চোরাচালানের পর থেকে আমাদের চা অবিক্রীত থাকছে ও তাদের সাথে মূল্যে টিকে উঠতে পারছি না। এভাবে চললে এক সময় চা আইনের ক্ষমতা ও চা ইন্ডাস্ট্রি বাংলাদেশে টিকে থাকবে না বলে এমনটাই ভাবছেন তিনি।
এদিকে পঞ্চগড় ঘুরে দেখা যায় প্রায় চা কারখানার সঠিক হিসেব নেই। যে যেভাবে পারছে সবুজ পাতা থেকে চা উৎপাদন করে সরাসরি মার্কেট এ বিক্রি করতেছে। সঠিক হিসেব থাকলেও তারা প্রতারণার মত বড় অপরাধ করে হিসেবের খাতা দু থেকে তিন ধরনের করে রেখেছে। যা চায়ের কাঁচা (সবুজ) পাতা ও কাঁচা পাতা থেকে উৎপাদিত ( মেট টি) এর কোন স্বচ্ছতা নেই। পঞ্চগড় চা বোর্ডের আঞ্চলিক কর্মকর্তার সাথে এ বিষয়ে কথা বললে তিনি বলেন_ আমরা তদারকি করতে গেলে তারা যে খাতাপত্র দেখায় আমরা সেটাই দেখি। এছাড়া আমরা অনেক সময় অবৈধভাবে চায়ের গাড়ি আটক করেছি ও বাংলাদেশ চা বোর্ড জরিমানা করেছে। এরকম অবৈধ অভিযান নিয়মিত চলবে।
চট্টগ্রাম এক চা বিডার ( চা ব্যবসায়ী) এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন__ আমরা আগে টাকা পাঠিয়ে দেই, অথবা কুরিয়ারের মাধ্যমে কন্ডিশনের মাধ্যমে চা তারা সরাসরি ফ্যাক্টরি হতে চা পাঠিয়ে দেয়। এই কারণে পঞ্চগড়ের চা নিলাম মার্কেট থেকে ক্রয় করতে হয় না। নিলাম মার্কেট থেকে ক্রয় করলে কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেশি দিতে হয়। নিলাম থেকে চা ক্রয় করবেন কিনা প্রশ্নের জবাবে বলেন, আগে পঞ্চগড়ের অবৈধ চা সারাদেশে ছড়ানো বন্ধ করুন তাহলে হয়ত সবাই নিলাম মুখী হবে ও সরকার রাজস্ব পাবে।
পঞ্চগড়ের নিলাম মার্কেট ও স্থানীয় কুরিয়ার সার্ভিসগুলোয় ঘুরে দেখা গেছে পঞ্চগড়ে অনলাইনের মাধ্যমে মাসে মাত্র ২ টি নিলাম অনুষ্ঠিত হয়।গত বছর নিলাম মার্কেট মোটামোটি ভাল চললেও এ বছরে মুখ থুবড়িয়ে গেছে। এ বছরের গড় নিলামে বিক্রি হয়েছে ( ৫০ কেজি বস্তা) ৫০০ থেকে ৭০০ বস্তা চা পাতা। আর কুরিয়ার সার্ভিসে ঘুরে দেখা গেছে গড়ে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১০০০ বস্তা চা বুকিং করছে । এছাড়া ছোট-বড় ও মাঝারি কাভার্ডভ্যানে সরাসরি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যাচ্ছে পঞ্চগড়ের চা।
