Saturday, March 15, 2025
Homeরংপুররংপুরের গঙ্গাচড়ায় সাব-রেজিস্ট্রার রিপনের রমরমা ঘুষ কারবার

রংপুরের গঙ্গাচড়ায় সাব-রেজিস্ট্রার রিপনের রমরমা ঘুষ কারবার

দলিল সম্পাদন অর্ধেকে, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, হয়রানির শিকার মানুষ

- Advertisement -

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

ডেস্ক: অভাবের কারণে জমি বিক্রির পরিকল্পনা করেন রংপুরের গঙ্গাচড়ার চয়ন চন্দ্র রায়। কাজটি সম্পাদন করতে গ্রাহককে নিয়ে যান উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। সেখানে দলিল লেখক দিয়ে তৈরি করেন নথি। সেটি অনুমোদনের জন্য নেওয়া হয় সাব-রেজিস্ট্রার রিপন চন্দ্র মণ্ডলের কাছে। জমিটি বাণিজ্যিক দাবি করে জায়গাটির মূল্য আরও বেশি বলে বেঁকে বসেন সরকারি কর্মকর্তা। টালবাহানা করেন দলিলে সই দিতে। মীমাংসা করার জন্য চান আড়াই লাখ টাকা। তাঁর চাহিদা অনুযায়ী অর্থ নগদ দেওয়ার পর আবেদনটি গ্রহণ করেন তিনি। এভাবে বেপরোয়া ঘুষ কারবার চলায় দলিল করতে আগ্রহ হারাচ্ছেন উপজেলার বাসিন্দারা। ধীরে ধীরে বিরান হচ্ছে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস।

দলিল লেখকরা জানান, আগে গঙ্গাচড়ায় মাসে অন্তত ৭০০ দলিল সম্পাদন হতো। সাব-রেজিস্ট্রার রিপন চন্দ্র যোগদানের পর গত দুই মাসে শর্তসাপেক্ষে মাত্র ৩২০টি দলিল হয়েছে। এতে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ভোগান্তি বেড়েছে মানুষের। এর আগে দিনাজপুরের বিরলে ছিলেন রিপন। সেখানে তাঁর অনিময়-দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন উপজেলার বাসিন্দা ও দলিল লেখকরা। তাদের প্রতিবাদের মুখে সেখান থেকে বদলি নেন তিনি। সে সময় রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডলের ভাগনে পরিচয়ে প্রভাব খাটিয়ে গত ৭ জুলাই গঙ্গাচড়ায় যোগ দেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও ঘুষের কারবার ছাড়েননি সাব-রেজিস্ট্রার রিপন চন্দ্র। তাঁর অনিময়-দুর্নীতি নিয়ে কথা বলায় দলিল লেখকদের সঙ্গেও করেন অসৌজন্যমূলক আচরণ। তাদের মুখ বন্ধ করতে জেলা রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে উপজেলা দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুজাউদ্দিন রানাকে সাময়িক বরখাস্ত করান।
উপজেলার দক্ষিণ পানাপুকুর এলাকার বাসিন্দা চয়ন বলেন, ‘টাকার খুব প্রয়োজন ছিল বলে ৮ শতক জমি ৫০ লাখ টাকায় কবলা করার জন্য সাব-রেজিস্ট্রার রিপন চন্দ্রকে আড়াই লাখ
টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হই। অন্যথায় জমিটি বিক্রিই করা হতো না।’

গত ২৯ জুলাই উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সেই ঘুষ লেনদেনের কথা স্বীকার করেছেন জমির গ্রহীতা গঙ্গাচড়ার দক্ষিণ কোলকোন্দ এলাকার বাসিন্দা মনিরুজ্জামান এবং দলিল লেখক আবদুল আউয়াল।
দলিল লেখক ও জমি বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১০ সেপ্টেম্বর গঙ্গাচড়ায় সাড়ে ১১ শতক জমির একটি দানপত্র দলিল সম্পাদন হয় (দলিল নম্বর-৩৭০৭)। খাজনা-খারিজ পরিশোধ না থাকায় আইনত জমির দলিলই হয় না। সাব-রেজিস্ট্রার ২০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে তা সম্পাদন করেন। এতে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। অবৈধ লেনদেনের বিনিময়ে দলিলটি সম্পাদন করার কথা স্বীকার করেছেন দলিলকারী উপজেলার দক্ষিণ কোলকোন্দ এলাকার শ্যামল চন্দ্র রায়। এর আগে ১৫ জুলাই সম্পাদিত ৬ একর ৪২ শতক জমির বণ্টননামা দলিলে (দলিল নম্বর-৩১৫৬) খাজনা-খারিজের কথা বলে নগদ ৬০ হাজার টাকা নিয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার রিপন চন্দ্র। বিষয়টি স্বীকার করেছেন দলিলদাতা ঠাকুড়াদহ এলাকার আমির হামজাসহ সংশ্লিষ্টরা।
গঙ্গাচড়ার চেংমারী এলাকার আবদুল গফুর, নওশের আলীসহ উপজেলার সাধারণ লোকজন জানান, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে এখন আর টাকা ছাড়া কলম চলে না। জমির দলিল করাতে গেলেই নানা অজুহাতে হয়রানি করা হচ্ছে। তবে কর্মকর্তাকে খুশি করলেই সব কাজ খুব সহজে হয়ে যায়। ঘুষ না দিলে দিনের পর দিন ঘুরতে হয়, কাগজের এখানে সমস্যা, সেখানে সমস্যা বলে পরে আসতে বলা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সব ক্ষেত্রে সংস্কার হচ্ছে; এলাকাবাসীর আশা ছিল, এখানেও পরিবর্তন আসবে। কিন্তু তা আর হয়নি, অসাধু কর্মকর্তারা বহালই আছেন।
উপজেলা দলিল লেখক সমিতির সভাপতি চাঁদ সরকার বলেন, প্রায় দুই দশক ধরে অন্য উপজেলার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দলিল সম্পাদনে রাজস্ব আদায়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে গঙ্গাচড়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিস। রিপন চন্দ্র যোগদানের পর দলিল সম্পাদন অর্ধেকে নেমেছে। তাঁর অনৈতিক আর্থিক চাহিদা পূরণ করতে না পারায় জমির নিবন্ধন নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে জনগণ। এতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন স্থানীয়রা, রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার, আয়-রোজগার প্রায় বন্ধের পথে দলিল লেখকদের।
অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ অস্বীকার করে সাব-রেজিস্ট্রার রিপন চন্দ্র মণ্ডল বলেন, ‘আইন মেনেই সবকিছু করা হচ্ছে। নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে না পারায় দলিল লেখকদের কেউ কেউ আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলছেন। তা ছাড়া নতুন আইন হওয়ায় শুধু গঙ্গাচড়াতেই নয়, সারাদেশেই দলিল সম্পাদনের হার কমেছে।’

  • সমকাল থেকে।
Facebook Comments Box
spot_img
এ বিভাগের আরও খবর
- Advertisment -spot_img

সর্বাধিক পঠিত খবর