অনিল চন্দ্র রায়, ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি:
দেশের উত্তরের সীমান্তঘেষা জেলা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে প্রায় তিনশ বছরের পুরোনো দোলের মেলায় হাজারও ভক্তের স্বত: স্ফূর্ত অংশগ্রহণে উদ্যাপিত হয়েছে। ফুলবাড়ী সদর থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তরপশ্চিম সীমান্তঘেষা নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের নাওডাঙ্গা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়িতে এ মেলাটি বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
শনিবার সন্ধ্যা প্রদীপ প্রজ্বলনের পরপরই জমিদারবাড়ির প্রাঙ্গণে আসতে শুরু করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দোল মূর্তি। দোলযাত্রায় গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাব ঘটে। ফলে বিভিন্ন এলাকা থেকে ভক্তরা ভগবানের মূর্তি (সিংহাসন) কাঁধে করে জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণে বি¯তৃর্ন ফাঁকা মাঠে নাচতে নাচতে আসেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই ভরে ওঠে পুরো মেলা প্রাঙ্গণ। এসময় দূরদূরান্ত থেকে আসা হাজারও ভক্তের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণে মুখরিত হয়ে উঠে জমিদারবাড়ির মেলা প্রাঙ্গণ।
এই গৌর পূর্ণিমায় আসলেই দোল উৎসবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার সখা সখিদের নিয়ে দোলায় চড়ে আনন্দ উৎসব করে। এই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দোল উৎসবটি প্রায় ৩শ বছর ধরে নাওডাঙ্গা জমিদারবাড়ির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ’দোলের মেলা’। নাওডাঙ্গা জমিদারবাড়ির দোলের মেলা এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী। বৃহত্তর রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে ভক্তরা এ মেলায় অংশ গ্রহণ করেন।
মেলা স্থানে সন্ধ্যার পর বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রতি বছরের মতো এ বছরও ৩৫টি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দোল মূর্তি নিয়ে আসা হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দোল মূর্তি ৮-১০ জন ভক্ত কাঁধে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেলা প্রাঙ্গণে ঢাক-ঢোলের বাজনায় পৌরাণিক নৃত্যের তালে তালে ঘুরে বেড়ান। এ সময় উপস্থিত ভক্তরা পরিবারসহ ভক্তিময় চিত্তে নিজেদেরকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে সমর্পণ করে এ মেলা রাত সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে উপভোগ করেন দোলের মেলা।
মেলা কমিটি জানায়, বাংলা ১৩০৪ সনে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর জমিদারের বংশধর সব কিছু ছেড়ে চলে যান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য কোচবিহার জেলায়। বর্তমানে তারা কোচবিহার জেলা শহরে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন। নাওডাঙ্গার জমিদারবাড়ির ঐতিহ্যবাহী জাঁকজমকপূর্ণ দোল উৎসবটি ধরে রাখার জন্য প্রতি বছর বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালন করে আসছেন স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।
১৫ মার্চ শনিবার সকাল ১০টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত মেলাটি চলে। এরপর রবিবার বাসি মেলাটি চলে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত নাওডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়ি মেলার সমাপ্তি ঘটে। অন্য দিকে একই ভাবে উপজেলার ভাঙ্গামোড় ইউনিয়নের রাবাইটারী দোলের পাঠ ও রাবাইটারী বসুনিয়াপাড়া দোলের পাঠ প্রাঙ্গণে দোল উৎসব পালন করা হয়েছে।
পূজারি বীরেন্দ্র নাথ বর্ম্মন ও সৌরেন্দ্র নাথ গোস্মামী জানান, তিনদিনব্যাপী দোল উৎসবটি
১৩ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে ন্যাড়া (ঘর) পোড়ানোর মধ্য দিয়ে দোলযাত্রার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
শুক্রবার (১৪ মার্চ) এ উপলক্ষ্যে উপজেলার বিভিন্ন মন্দিরে পূজা, হোম যজ্ঞ, প্রসাদ বিতরণসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। ধর্মের অনুসারীরা প্রতিটি মন্দিরে সকাল থেকে শতশত ভক্তের সমাগম ঘটে এবং ভক্তরা রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহের সামনে রাঙিয়ে তুলেন নিজেদের। এছাড়া দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা তাদের মনের কামনা বাসনাসহ সংসারে সুখ-শান্তির জন্য প্রার্থনা করেন।
এই দুই পূজারি আরও জানান, দোলযাত্রা হিন্দু বৈষ্ণবদের উৎসব। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, এ দিন শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে রাধিকা এবং তার সখীদের সঙ্গে আবির খেলেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি। এ কারণে দোলযাত্রার দিন এ মতের বিশ্বাসীরা রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ আবিরে রাঙিয়ে দোলায় চড়িয়ে নগর কীর্তনে বের হন। এ সময় তারা রং খেলার আনন্দে মেতে ওঠেন। পুষ্পরেণু ছিটিয়ে রাধা-কৃষ্ণ দোল উৎসব করা হতো। সময়ের বিবর্তনে পুষ্পরেণুর জায়গায় এসেছে ‘আবির’। শুক্রবার দোল উৎসবে দ্বিতীয় দিনে দিনব্যাপী উপবাস থেকে ভক্তরা শ্রী কৃষ্ণের চরণে ধাবিত হয়। শনিবার সকালে পূজা শেষে দুপুর ১২ টায় বিভিন্ন এলাকায় জাতের বাড়িতে দোল মূর্তি নেই, সেই সকল বাড়িতে নিমন্ত্রণ পালন করতে সওয়ারীরা বাহারি সাজে সজ্জিত হয়ে দোল মূর্তি সিংহাসনে কাঁধে নিয়ে যান। সেখানে বাড়ির লোকজন দোল ঠাকুরের পূজা অর্চনা ও বরণ করে এবং পায়ে আবির দিয়ে পরিবার ও জগতের মঙ্গল কামনা করে। পরে সন্ধ্যা নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ির দোল মেলায় অংশ নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত আনন্দমুখর পরিবেশে দোল উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
রংপুর থেকে আসা ভক্ত নির্মল চন্দ্র দেবনাথ ও সঞ্চয় চন্দ্র রায় বলেন, বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে সবচেয়ে দোল উৎসব হয় ‘নাওডাঙ্গা জমিদারবাড়ি’ প্রাঙ্গণে। তারা প্রতিবছরই এখানে আসেন দোল উৎসব উপভোগ করার জন্য। এবারে জাঁকজমকপূর্ণ ছিল মেলাটি।
লালমনিরহাট থেকে আসা ভক্ত প্রশান্ত সেন, দীপ্তি রানী ও দুর্জয় চন্দ্র রায় জানান নাওডাঙ্গা জমিদারবাড়ি’ প্রাঙ্গণের দোল উৎসব ঐতিহ্যবাহী। দোল উৎসব উদ্যাপন করতে এখানে আসলে আমাদের শান্তি অনুভূত হয়। “শৈশবকাল থেকে এখানকার দোল উৎসব অংশগ্রহণ করে আসছি।
দোলের মেলা উদ্যাপন কমিটির সদস্য হৃষিকেশ চন্দ্র রায় (ভোলা) রতন চন্দ্র রায় বলেন, ভক্তদের উৎসবমুখর অংশগ্রহণে প্রতি বছরের মতো এবছরও দোলের মেলা শান্তিপূর্ণভাবে উদ্যাপিত হয়েছে। ফুলবাড়ী থানার পুলিশ মেলায় সার্বিক নিরাপত্তা দেয়ায় পুলিশ বাহিনীসহ স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীদের মেলা কমিটির পক্ষ ধন্যবাদ। তারা জানান, এখন জমিদার নেই কিন্তু জমিদারবাড়ি রয়েছে। জমিদারবাড়ি প্রাঙ্গণে দোল উৎসবের আয়োজন করা হয়। তবে জায়গা সংকুলাণ না হওয়ায় অনেক সময় দোল নিয়ে ভক্তরা তেমন পৌরাণিক নৃত্যে পরিবেশন করতে পারেন না। রাত সাড়ে ১২টা মেলায় অংশ নেয়া দোল মূর্তি এগুলোকে বিদায় জানানো হয়েছে। মেলায় শতশত দোকানর বেচাবিক্রি চলে রাত দেড়টা পর্যন্ত। রবিবার বাসি মেলা মেলা চলে দিন ব্যাপী।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ ফুলবাড়ী উপজেলা শাখার সভাপতি কার্তিক চন্দ্র সরকার ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টাণ, ঐক্য পরিষদ ফুলবাড়ী উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অনীল চন্দ্র রায় জানান, তিন ব্যাপী দোল উৎসব চলাকালীন সময়ে আমরা সব সময় খোঁজ খবর নিয়েছি। বিশেষ করে শনিবার নাওডাঙ্গা জমিদারবাড়ীসহ তিনটি স্থানে উৎসবমুখর পরিবেশে দোল উৎসব উদ্যাপিত হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করেছি, প্রতি বছর যেভাবে দোল উৎসব হয়ে আসছে, ঠিক একই ভাবে এবারও দোল উৎসব হয়েছে। ফুলবাড়ী থানা পুলিশের ব্যাপক ভুমিকায় অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শান্তিপূর্ণভাবে দোল উৎসব পালন করেছে। সেই সাথে তিন মেলা প্রাঙ্গণে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরাও মেলা শান্তিপূর্ণভাবে করতে তাদেরও ব্যাপক ভুমিকা থাকার পূজা ও ঐক্য পরিষদের পক্ষ ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
ফুলবাড়ী উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান মুকুল জানান, নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ি দোল উৎসব ঘুরে দেখেছি, আমি বলবো উত্তর জনপদের জনপ্রিয় এই উৎসব অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে। মেলা শুরুর একসপ্তাহ ধরে নাওডাঙ্গা বিএনপিসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মেলা শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে কাজ করেছে। বিএনপি সব সময় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। শুধুই ফুলবাড়ীতে নয় বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণ ভাবে তাদের ধর্ম ও উৎসব পালন করবে এটাই বিএনপির আদর্শ।
শনিবার নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ির দোল উৎসব পরিদর্শন এসে কুড়িগ্রাম জেলা জামায়াতের সদস্য রফিকুল ইসলাম ও নাওডাঙ্গা ইউনিয়ন জামায়াতের আমির সামছুল হুদা বাবুল মাস্টার জানান, মেলা শুরুর আগে আমরা মেলা কমিটিকে নাওডাঙ্গা ইউনিয়ন জামায়াত আপনাদের সহযোগিতা করবে। আপনারা সুন্দরভাবে মেলা উদ্যাপন করবেন বলে জানিয়েছি। আসলেই তারা অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশ মেলা উপভোগ করছে, দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছে। এ সময় তারা আরও জানান, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সরকার গঠন করলে আপনান আরো সুন্দরভাবে আপনাদের উৎসবগুলো পারবেন।
ফুলবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মামুনুর রশিদ জানান, ঐতিহ্যবাহী নাওডাঙ্গা জমিদারবাড়ির দোল উৎসবের সাথে উপজেলার রাবাইটারী ও বসুনিয়াটারী দোল মন্দির প্রাঙ্গণে দোল উৎসব শান্তিপূর্ণ করতে সকলের সহযোগিতায় পেয়েছি। পুলিশের ব্যাপক নিরাপত্তা জোড়দার, মেলা কমিটি, শুশীল সমাজসহ স্থানীয় নেতাকর্মীদের সক্রিয় ভূমিকা থাকায় প্রতি বছরের মতো এবছর ঐতিহ্যবাহী দোল উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে।