অনিল চন্দ্র রায়, ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি:
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম লাইনগুলো লিখেছিলেন নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে। কিন্তু আজও সমাজের প্রতিটি প্রান্তে নারীরা নির্যাতিত, নিপীড়িত। নারীর অধিকার সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে । এতো আন্দোলন, সভা সেমিনারের মাধ্যমে নারীদের নির্যাতন ও বৈষম্য বন্ধে কাজ করলেও দুর হচ্ছে নির্যাতন ও বৈষম্য। আজও রোদ-বৃষ্টি ও ঝড়ের মাঝে পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করলেও নারীরা পান কম পারিশ্রমিক।
শুক্রবার (৮ মার্চ) বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষ্যে নারীদের ভাবনা জানতে কথা হয় কুড়িগ্রামের নারী দিনমজুর ছামিনা বেগমের সাথে। নারী দিবসে প্রত্যাশার কথা জানতে চাইলে তিনি জানান, “মাঠে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমরা কাজ করি ট্যাকা (টাকা) পাই সংসার চালাই। নারী দিবস কী জানি না বাহে। জানলেও বা কী হবে ? গরীব মানুষ কে বা খোঁজ রাখে বাহে ! একজন পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করার পরও নারী বলে আমরা মজুরি কম পাই। কই এনিয়ে তো কেউ কথা বলে না। অনেক নারী আজ শতশত নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অথচ কোন বিচার নেই। তাহলে আপনি বলেনতো নারী দিবস আমাদের জানাটা কী জরুরী ?”
ছামিনা বেগম আরও জানান “আমার স্বামী (হাসেন আলী) তিন বছর ধরে অসুস্থ। দুচোখে কিছু দেখেন না। বাড়ীতে অন্ধত্ব জীবন পাড় করছেন। স্বামী অসুস্থ হওয়ায় পাঁচ সদস্যদের ভরণপোষণের দ্বায়িত্ব ৫১ বছরের ছামিনা বেগমের কাঁধে। মাত্র ২০০ থেকে ২৫০ টায় কোন রকমেই খেয়ে না খেয়ে দিন পাড় করেছেন ওই পরিবারটি। রমজান মাসে অনেকেই ভালো কিছু খাইলেও তাদের মুখে জোটেনা ভালো খাবার। অন্যের দেয়া খাবারে ইফতার করেন ছামিনা বেগম। রমজানে তিনিসহ তার পরিবার অতিকষ্টে জীবন নির্বাহ করছেন। ওই পরিবারটিতে নেই কোন সরকারি সুযোগ সুবিধা। টাকার অভাবে স্বামীর চিকিৎসা বন্ধ হয়েছে অনেক আগে। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই দুচিন্তা বাড়ছে”।
কুরুষাফেরুষা গ্রামের নারী দিন মজুর মহিমা বেগম ও পূর্বফুলমতি নারী শ্রমিক মন্জু রানী সেন বলেন, “বাহে কি কইবেন কন তাড়াতাড়ি কারণ রৌদ্রের মধ্যে কাজ করছি। আজ যে নারী দিবস আমরা জানি না। জেনে আমাদের লাভ নেই। দেখেন এখানে ২০ থেকে ২৫ নারী আলু তোলার কাজ করছি। আমাদের মজুরী কত শুনবেন। আমাদের মজুরী মাত্র ১০ কেজি করে আলু দিবেন জমির মালিক। আলু বিক্রি করে বড় জোড় ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা আসবে। আপনি বললেন নারী দিবস আজ। নারী দিবসে কী নারী শ্রমিকদের মজুরী কম এবং অনেক অনেক আজ নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাদের বিষয়ে কথা বলবে। জানি বলবে না। আমরা নারী সব সময় বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এটা কেউ দেখবেও না শুনবেও না। একটা কথা বলি। আপনি দেখেন আমরা নারীরা মাটি কাঁটা, ধান কাঁটা, ধান রোপন করা, ধান নিড়ানি সব ধরণের কাজ করি। অথচ পুরুষের তুলনায় টাকা পাই কম। কম টাকায় আমরা কোনরকম ভাবে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছি। আমরা সরকারের কাছে নারীদের মজুরি বৈষম্য দুর করাসহ নারী নির্যাতনকারীর শাস্তির দাবি জানাই।
শিক্ষার্থী মিষ্টি খাতুন বলেন, “চলাচলের পথে নারীদের যাতায়াত ব্যবস্থা আজও নিরাপদ নয়। পাবলিক পরিবহনে নারীর জন্য সিট বরাদ্দ থাকলেও তারা তা পান না। অনেক সময় পুরুষরা নারীর পোশাক, চলাচল নিয়ে বাজে বাজে মন্তব্য করে। এতে নারীর অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। নারী পরিবার বা সমাজ কোথাও নিরাপদ নয়। তাই নারীর সম্মান ও নিরাপদ নিশ্চিতসহ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন”।
ফুলবাড়ী জছিমিয়া মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা আকতারা বেগম বলেন, “এক সময় নারীরা অনেক পিছিয়ে ছিল। সেই তুলনায় এখন কিন্তু অনেক এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। এক সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীরা কাজ করার কথা চিন্তাই করতেন না। এখন পুলিশ, আর্মি, পাইলট, ডিফেন্সে নারীরা কিন্তু অংশগ্রহণ করছে। মেট্রোরেল চালাচ্ছে নারী। এটা একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন। নারীরা পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। একজন নারী তার স্বামী সংসার সামলে কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে হয়। নারীর অধিকার নিশ্চিত করার পথটা মসৃণ নয়। গ্রামের নারী শ্রমিকরা এখনও মজুরি বৈষম্যে শিকার হচ্ছে এবং নির্যাতন ও বন্ধ হচ্ছে না।আমি চাই পুরুষরা নারীকে সম্মানের সঙ্গে তাদের প্রাপ্য অধিকার দিক। একটা সময় নারীরা নির্যাতনের শিকার হলেও প্রতিবাদ করেনি। এখন কিন্তু প্রতিবাদ হচ্ছে। থানায় এসে নির্যাতনের অভিযোগ মামলা করছে। এখন সব কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। কাজেই আশাকরি প্রত্যেকটা নারী সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়। বাহিরের দুনিয়ায় কি হচ্ছে দেখে প্রতিবাদ জোড়ালো হলেই একটা সময় এসে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।