Saturday, March 15, 2025
Homeআইন-আদালতঅপরাধ ও দুর্নীতিপঞ্চগড়ে অবৈধ চায়ে মাসে আড়াই কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে কুরিয়ারের...

পঞ্চগড়ে অবৈধ চায়ে মাসে আড়াই কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে কুরিয়ারের মাধ্যমে।

লোকসানে কৃষক ও গোটা বাংলাদেশের চা শিল্প, নেই সচ্ছতা। সরকার চাইলেই চা সিন্ডিকেট ভাঙ্গা সম্ভব।

- Advertisement -

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

স্টাফ রিপোর্টার: পঞ্চগড় চায়ের মার্কেট থেকে মাসিক ২ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকারও বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর মাধ্যমে। সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র সরাসরি চা কারখানা থেকে নিলামবহির্ভূত এসব অবৈধ চা বের করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চা হোলসেলারদের কাছে বিক্রি করে আসতেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় চা কারখানার মালিকদের সাথে সমন্বয় করে রাতের আধারে এসব চা বের করে নেয়, সুযোগ বুঝে সারাদিন থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কুরিয়ার সার্ভিসে এইসব অবৈধ চা পাতা বুকিং করে আসছে।

কুরিয়ার সার্ভিসগুলোয় গিয়ে দেখা পঞ্চগড় থেকে গড়ে প্রতিদিন ছয়শত থেকে সাতশত বস্তা চা পাতা কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর মাধ্যমে দেশের বিভিন্নপ্রান্তে বুকিং হচ্ছে। যা সম্পূর্ণরূপে নিলামবহির্ভূত ও অবৈধ প্রক্রিয়া। এসবের জন্য পঞ্চগড় জেলা থেকে চায়ের উপকর ও রাষ্ট্রের মাসিক ২ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকারও বেশি রাজস্ব খেয়ে ফেলছে এই চক্রগুলো। দেখা গেছে __ উৎপাদিত কালো চায়ের প্রতি বস্তায় সরকারের ভ্যাট+ট্যাক্স থাকে সর্বনিম্ন ১২৮০ টাকা। আনুমানিক প্রতিদিন গড়ে ৭০০ বস্তায় সরকারের ভ্যাট ও ট্যাক্স মিলিয়ে থাকে ৮ লক্ষ ৯৬ হাজার টাকারও বেশি যার মাসিক ভ্যাট ও ট্যাক্স গিয়ে অঙ্কের টাকা ভারি হয়ে দাঁড়ায় ২ কোটি ৬৮ লক্ষ ৮০ হাজার টাকারও বেশি। সে হিসেব অনুযায়ী পঞ্চগড় জেলা থেকে বছরে রাজস্বের হারের একটা বিশাল অংশ খেয়ে ফেলছে চা কারখানার মালিক ও চক্রটি।

কুরিয়ার সার্ভিসে গিয়ে দেখা গেছে প্রতিটি কুরিয়ার চাপাতা বুকিং দেওয়ার জন্য ব্যস্ত সময় পার করছে। জেলা বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লড়ি, অটো, ভ্যান এমনকি মোটরসাইকেল এর পিছনে করে নিয়ে আসছে ৫০ কেজির চায়ের বস্তা। এমনকি কুরিয়ার সার্ভিসগুলো এসব অবৈধ চায়ের জন্য আলাদা গুদাম করে নিয়েছে। গুদামে দেখা যায় ৫০ কেজির ( CTC Black Tea) সিটিসি ব্ল্যাক টি নামের চায়ের বস্তায় কোন কারখানার নাম নেই। নাম নেই জানতে চাইলে কোন একজন বলে দেয়, যেহেতু ধরা পড়লে কারখানার নামের বদনাম হবে ও ধরা পড়তে পারে তাই শুধু বস্তার গায়ে CTC Black Tea ( Produced of Bangladesh) লেখা থাকে। এমনকি কিছু বস্তার গায়ে উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণ তারিখও লেখা নেই। অথচ এ সকল চা প্যাকেটজাকারীদের কাছে গিয়ে প্যাকেট এ মেয়াদ ও বিএসটিআই এর সাথে সম্পৃক্ত হবে। এ বিষয়ে বিএসটিআই রংপুরের উপ-পরিচালাক প্রকৌঃ মুবিন-উল-ইসলাম (পদার্থ) রংপুর, বলেন_ আমরা বিষয়টি নিয়ে অবগত ছিলাম না। এটা সম্পূর্ণ অন্যায়। দিনাজপুর অফিসকে অবগত করে বিষয়টি নিয়ে কাজ করব। দিনাজপুরের বিএসটিআই এর উপ-পরিচালক মোঃ জহুরুল ইসলাম (সিএম) ও অফিস প্রধান বলেন _ আমরা বিষয়টি জানতাম না। তবে এসব কিছু হলে ব্যবস্থাগ্রহন করা হবে ও কোন চা কারখানা এসব করতেছে তাদের একটা তালিকা প্রস্তুত করা হবে, এর জন্য স্থানীয়ভাবে সাহায্যের দরকার হবে।

উপরিউক্ত বিষয়টি যে কুরিয়ার সার্ভিস ও বিএসটিআই এর দোষ তা নয়, মূলত সরকারে রাজস্ব ফাঁকি ও চোরাই পথে চা বিক্রির একটা বড় চক্র কাজ করছে পঞ্চগড়ের চা শিল্পকে কেন্দ্র করে। ইতি মধ্যেই চক্রটি শত কোটি টাকা এ পন্থায় বাগিয়ে নিয়েছে। পঞ্চগড়ের চা শিল্প উন্নয়ন, রাজস্ব ও কৃষকদের ন্যায্যমূল্যের জন্য গতবছর চালু হয়েছে চায়ের নিলাম কেন্দ্র। মাত্র এক বছরের মাথায় মুখ থুবরিয়ে পড়ার মত অবস্থায় রয়েছে নিলামকেন্দ্রটি। এছাড়াও এ জেলার একটা বড় অংশের রাজস্ব আহরণের পণ্য এই সমতলের চা শিল্পের থেকে আসে। কিন্তু সঠিক দতারকি ও স্বচ্ছ জবাবদিহিতার কারণে একদিকে সরকারের রাজস্ব হারাচ্ছে অন্যদিকে ধ্বংস হচ্ছে চা শিল্প ও কৃষকের ন্যায্য মূল্য।

পঞ্চগড়ে কুরিয়ার থেকে ২১২ বস্তা চা জব্দ, গোডাউন সিলগালা: ফাইল ছবি।

এ বিষয়ে পঞ্চগড় ডেপুটি কমিশনার ভ্যাট ও কাস্টমস মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন_ আমি এ জেলায় গত সপ্তাহে এসেছি। বিষয়টি অনেক গুরত্বপূর্ণ, আপনাদের সহযোগিতা ও তথ্যের ভিত্তিতে চা চোরাচালান বা ভ্যাট ফাঁকি নিয়ে কাজ করবো। এছাড়া সব কিছু গুছিয়ে উঠে মাঠ পর্যায়ে আমরা অ্যাকশনে যাব।

আরও পড়ুনঃ পঞ্চগড়ে ৮ দফা দাবিতে সড়কে চা পাতা ফেলে চাষীদের মানববন্ধন

পঞ্চগড় নিলামকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে মাসে দুটি নিলাম থেকে গড়ে ৫০০/৬০০ বস্তা চা বিক্রি হয়েছে। সেগুলো স্থানীয় বিডার দ্বারা নিলামকৃত। অথচ কুরিয়ারে গড়ে প্রতিদিন ৫০০/৬০০ বস্তা চা বিক্রি হওয়ার বিষয়টি নিয়ে চা ব্রোকার্স এর কর্মকর্তা বলেন__ কিছু ব্যবসায়ী চা কারখানার সাথে লিয়াঁজো করে পাঁচ থেকে ১০ লট চা ক্রয় করে একই কাগজ ও ভ্যাট চালান ৬.৩ পূরণ করে তারা পরবর্তী চাগুলো অকশন ছাড়া কুরিয়ার ও কাভার্ডভ্যানে নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ডেলিভারি দিয়ে যাচ্ছে। মোটকথা সঠিক ভাবে নিলামের ১০% দেখিয়ে ৯০% চা চোরাই পথে বিক্রি করে। যদি প্রশাসন এসব অবৈধ চা জব্দ করে ও ব্রোকারের নিলামকৃত চায়ের স্যাম্পলিং এর সাথে মিলিয়ে নেয় তাহলে এ সকল অবৈধ চা শনাক্ত করা সম্ভব। এছাড়া প্রয়োজনে ডেলিভারি রিপোর্ট চায়ের বস্তার ইনভয়েস নম্বর ও স্যাম্পলিং পরীক্ষা করা সহ সব বিষয়ে প্রশাসনকে সহায়তা করা হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা বলেন, আমরা অনেক চা পাতা দেশের বিভিন্নপ্রান্তে ডেলিভারি দিয়ে থাকি, কিন্তু সেগুলো নিলামের চা কিনা আমাদের জানা নেই। আমাদের কাজেই হলো যে কোনো বৈধ পণ্য ডেলিভারি দেওয়া, বাকিগুলো তো সরকারের দায়িত্ব। তারা আমাদের সব বুঝিয়ে দিলে আমরা বুঝতে পারব।

এ বিষয়ে কর্ণঝড়া টি কারখানার প্রজেক্ট ডিরেক্টর মোঃ শাহ হাসান আহমেদ রুশদি বলেন, আমি শুনেছি কিছু অসাধু কারখানার মালিক ও বায়ার এসব কাজ করে আসছে। এগুলো বন্ধ করার জন্য যদি সরকার ভ্যাট কমিয়ে দেয় তাহলে হয়তো বায়ারগণ নিলামমূখি হবে। এছাড়া সরাসরি চা কারখানা হতে চা বিক্রি করার একটা অফশন থাকলে আরও ভাল হত।

এ সকল বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ সাবেত আলী বলেন__ আমি যেহেতু নতুন এসেছি ও চা বিষয়ে অবিজ্ঞতা কম তাই আমি সবার সাথে বসবো এবং সব কিছু জেনে বুঝে মাঠ পর্যায়ে ও চায়ের উপর সব বিষয়ে আলাদা নজর দিব, এছাড়া যেহেতু জেলা ব্রেন্ডিং এ পঞ্চগড়ের চা তাই এখানে একটু বেশি নজর থাকবে ও চা আইন-২০১৬ মেনে নিয়মিত চায়ের উপর মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করা হবে।

আরও পড়ুনঃ সমতলের চা কারখানার জন্য হুমকির মুখে গোটা বাংলাদেশের চা ইন্ডাস্ট্রি।

অবৈধ চা চোরাচালানের কারণে ভালো নেই চা সেক্টরের সকলেই। একদিকে অনিয়ম, চোরাচালান, দুর্নীতি অন্যদিকে মার্কেটের সাথে তালমিলিয়ে ছন্দে ফিরতে পারছে না শতভাগ নিলামকরা চা বায়ারগণ। চোরাই পথের চায়ের সাথে ৬০/৮০ টাকার একটা বিশাল অঙ্কের তফাত। এমন অবস্থা থাকলে তারা একদম নিলাম থেকে চাপাতা ক্রয় করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এদিকে এ সকল অবৈধ চায়ের জন্য ও কৃষকদের ন্যায্য মূল্যের জন্য পঞ্চগড় জেলার চা বাগান মালিক সমিতি ও জেলা সমন্বায়ক মিলে ” চা চোরা চালান রোধ ” নামের একটি টিম গঠন করেছে। তারা বলেছে, প্রয়োজনে আমরা সবার থেকে স্বচ্ছ জবাবদিহিতা নিব ও চা চোরাচালান ঠেকাতে যে কাজগুলো করা দরকার, সবাই মিলে ঠিক সে সকল কাজ করে যাব। এগুলো আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে, প্রয়োজনে আমরা কুরিয়ার সার্ভিস সহ প্রত্যেকটা কাভার্ডভ্যান চেকআপ করব। এছাড়া আমরা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীকে সাথে নিয়ে কাজ করবো। প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ও প্রশাসনকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার সব রকম সাহায্য ও সহযোগিতা করব।

কুরিয়ার সার্ভিস থেকে অবৈধ চা আনলোড হচ্ছেঃ ফাইল ছবি।

গতবছর কৃষকদের ন্যায্য অধিকারের জন্য নিলাম সেন্টার উদ্ধধোন হলেও কৃষকের জন্য কিছুই হয়নি। বরং যে লাউ সেই কদু অথবা এ যেন মোর তাল পাতার বাতাসের মত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। চায়ের উপর কৃষক থেকে মার্কেটারের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক জ্ঞানের অভাব। যে যেভাবে পারে যাকে বুঝিয়ে যেমন কাজ করে। কেউ মাথা ঝুঁকিয়ে বলে হ্যাঁ, আর কেউ না বুঝিয়েই বলে হ্যাঁ, আবার কেউ ভুলভাল বুঝিয়েই বলে হ্যাঁ। কিন্তু সব কিছুতেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা রয়েছে এই চা শিল্পের সকল স্তরেই। তাই এখন সাধারণ জনগণ ও চা সেক্টরের সংশ্লিষ্টরা চায় সব কিছু নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হোক ও কৃষক থেকে সকল পর্যায়ের চায়ের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান তাদের দাবি আদায় করুক। সবাই আশাবাদী পঞ্চগড়ের চা শিল্পের সব রকম অস্থিরতা ও অসচ্ছলতা দূর হলে ভাল থাকবে গোটা বাংলাদেশে চা শিল্প। সরকার যদি ইচ্ছে করে তাহলে এই স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে সময়ের দাবি মাত্র বলে অনেকেই মনে করছেন।

অনুসন্ধানী ও  ধারাবাহিক নিউজ।
তথ্য দিতে: news.rangpurnews@gmail.com
Facebook Comments Box
spot_img
এ বিভাগের আরও খবর
- Advertisment -spot_img

সর্বাধিক পঠিত খবর