অনিল চন্দ্র রায়, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ
দেশের বৃহত্তম রংপুর অঞ্চলের ঐতিহাসিক ও এতিহ্যবাহী সিন্দুরমতি তীর্থধাম মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় তিনশ বছরের অধিককাল ধরে সিন্দুরমতি দিঘির পাড়ে সিন্দুরমতি তীর্থধাম মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এটি দেশের উত্তরের জেলা লালমনিরহাট সদর উপজেলা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের সিন্দুরমতি গ্রামে। প্রতি বছর বর্ণাঢ্য আয়োজনে চৈত্র মাসে রাম নবমী তিথীতে সিন্দুরমতি তীর্থধামে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল রবিবার ভোর থেকে রংপুর অঞ্চেলের বিভিন্ন এলাকা থেকে এ তীর্থধাম মেলায় হাজার হাজার তীর্থধামযাত্রী অংশগ্রহণ করেন। দিন ব্যাপী মেলায় লাখো দর্শনার্থীদের রূপ নেয়। তারা সিন্দুরমতি দিঘিতে স্নান করে ‘পুণ্য লাভ ও প্রশান্তি’ চেয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করেন।
আয়োজক কমিটি জানান, সিন্দুরমতি পুকুরের পাড়ে রয়েছে সিন্দুরমতি মন্দির, দুর্গা মন্দির, শিব মন্দির, রাম মন্দির, কৃষ্ণ মন্দির, কালী মন্দির ও রাধাগোবিন্দ মন্দির। সিন্দুরমতি মেলায় প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ শাস্ত্রীয়মতে ‘সখা-সখি’ সম্পর্ক স্থাপন করে থাকেন। শাস্ত্রীয় মতে তৈরি হওয়া সম্পর্ককে সবচেয়ে ‘আপনজন’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ মেলা থেকে সিঁদুর কিনে তা বিতরণ করা একটি ঐতিহ্য।
সিন্দুরমতি তীর্থধাম সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি পবিত্র তীর্থস্থান। এটি সিন্দুরমতি দিঘিকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত । ১৯৭৫ সালে সরকারি উদ্যোগে সিন্দুরমতি দিঘি সংস্কারের সময় প্রাচীনকালের অনেক মুদ্রা ও মূর্তি পাওয়া যায় যা বর্তমানে জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
কথিত আছে জমিদার রাজ নারায়ণ চক্রবর্তী সন্তান লাভের বাসনায় এই দিঘিটি খনন করেন। তার দুটি কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাদের নাম রাখেন সিন্দূর ও মতি । কিন্তু খননকাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পরও দিঘিতে তেমন জল থাকতো না। স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়ে জমিদার রাম নবমীর তিথীতে দিঘির মাঝখানে পূজাসহ বিশেষ যজ্ঞের আয়োজন করেন। সেসময় অন্যান্য সাধু সন্ন্যাসী, ভক্তদের পাশাপাশি তার দুই মেয়ে সিন্দূর ও মতি সেখানে অবস্থান করছিল। পূজা সমাপ্ত হওয়ার আগেই হঠাৎ প্রবল বেগে জল উঠা শুরু হয়। দিঘির মাঝ স্থান থেকে উপস্থিত সকলেই পাড়ে উঠলেও সিন্দূর ও মতি অথৈ জলে তলিয়ে যায় এবং দেবত্ব প্রাপ্ত হয়ে অমরত্ব লাভ করে। সেই থেকে এই দিঘির নাম হয় সিন্দুরমতি এবং গ্রামটির পরিচিত পায় সিন্দুরমতি গ্রাম হিসেবে।
রংপুর থেকে আসা তীর্থযাত্রী বিমল চন্দ্র রায় ও ফুলবাড়ী খেকে আসা পুণ্যার্থী দিনোবন্ধু রায় জানান, আমরা গেল ২০ বছরধরে সিন্দুরমতি তীর্থধাম মেলায় অংশগ্রহণ করছি। সিন্দুরমতি দিঘির জলে স্নান করলে পুণ্যলাভ হয় ও প্রশান্তি পাওয়া যায়।
কুড়িগ্রাম সদর থেকে আসা তীর্থযাত্রী চিত্রা নারী সরকার ও লিমা রানী রায় জানান’ আমরা এ সিন্দুরমতি তীর্থধাম মেলায় সিঁদুর কিনে বিতরণ করি। এতে আমাদের পুণ্যলাভ হয়।
লালমনিরহাটের আদিতমারী থেকে আসা তীর্থ যাত্রী রমণী চন্দ্র সরকার (৬৫) বলেন, তিনি শৈশবকাল হতেই সিন্দুরমতি তীর্থধাম মেলায় আসেন। এ তীর্থধাম মেলা তাদের কাছে একটি মহা পবিত্র তীর্থস্থান। এখানে তিন্দুরমতি দিঘির জলে স্নান করে মন্দিরে দেব-দেবীর চরণে পূজার্চনা করলে পুণ্যলাভ ও প্রশান্তি মেলে।
সিন্দুরমতি তীর্থধামে পূজারি (পুরোহিত) শঙ্কর চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে সিন্দুরমতি তীর্থধাম মেলার তাৎপর্য অনেক। এখানে ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সিন্দুরমতি তীর্থধাম মেলা এগিয়ে রয়েছে। প্রতি বছর রাম নবমী তিথীতে সিন্দুরমতি তীর্থধামে আসলে তীর্থযাত্রীরা ভগবানের আর্শীবাদপ্রাপ্ত হন।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ লালমনিরহাট জেলা শাখার সভাপতি হীরালাল রায় বলেন, তিনশ বছরের অধিককাল ধরে সিন্দুরমতি তীর্থধাম মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সিন্দুরমতি দিঘির পাড়ে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরগুলোতে নিয়মিত পূজার্চনা হয়। রংপুর অঞ্চলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র তীর্থস্থানগুলোর মধ্যে সিন্দুরমতি তীর্থধাম অন্যতম। প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতি বছর মূল মেলার পরের দিন আজ সোমবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসিয়া মেলায় অনুষ্ঠিত হবে।
লালমনিরহাট সদর থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ নূরনবী বলেন, সিন্দুরমতি তীর্থধাম মেলায় আগত তীর্থযাত্রীদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। মেলাজুড়ে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আজ সোমবার মেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ সেখানে অবস্থান করবে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার ঐতিহ্যবাহী সিন্দুরমতি তীর্থধাম মেলা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন কালে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, মেলায় বাংলাদেশ সেনা বাহিনী, পুলিশ, আনসার, গ্রাম পুলিশ এবং দিন ব্যাপী দুইজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এছাড়াও পর্যাপ্ত পরিমাণ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে ছিলেন। ফলে মেলাটি অত্যন্ত ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ সোমবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সেখানে অবস্থান করছে। তিনি আরও জানান, সিন্দুরমতি তীর্থধামের সীমানা জটিলতাসহ দখল হওয়া জমি উদ্ধারের জন্য জেলা প্রশাসক কাজ করছে। আশারাখি অল্প সময়ের মধ্যে তা নিরসন হবে।
রবিবার শেষ বিকালে সিন্দুরমতি তীর্থধাম মেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে মেলা ঘুরে দেখেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হাবীব দুলু। পরে মন্দির প্রাঙ্গণে এক আলোচনা সভায় সিন্দুরমতি তীর্থধামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর সিন্দুরমতি মেলাটি জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে হয়েছে এবং পুণ্যার্থীর সংখ্যাও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আরও জানান প্রতি বছর সিন্দুরমতি মেলা তিন চার লাখ টাকা ডাকতো এবং তীর্থ স্থানে জুয়া ও সার্কাসের নামে অশ্লীল নৃত্য পরিবেশন হতো। এই তীর্থধামে এবছর সেটা হতে দেয়নি। এই মেলাকে ঘিরে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্র দলের নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণ এবং সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফেরাতে কাজ করেছে। যার কারণে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পুণ্যার্থী, ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বসিয়েছেন তাদের কোন ধরনের হয়রানি চাঁদা ছাড়াই তারা শান্তি পূর্ণ ভাবে বেচা বিক্রি করেছেন। অধ্যক্ষ আসাদুল হাবীব দুলু আরও জানান, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সিন্দুরমতি তীর্থ স্থানের জমি দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করা হবে। এ ব্যাপারে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের নিদের্শনায় সদর উপজেলা অফিসার (ইউএনও) কাজ করে যাচ্ছেন। আশাকরি অল্প সময়ের মধ্যে জমি উদ্ধারসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধান হবে৷