Sunday, April 20, 2025
Homeসারাদেশচট্টগ্রামে খালে পড়ে শিশুর মৃত্যু

চট্টগ্রামে খালে পড়ে শিশুর মৃত্যু

- Advertisement -

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

রংপুর নিউজ ডেস্কঃ

চট্টগ্রাম নগরীর খোলা খাল ও নালাগুলো এখন আর শুধু জলাবদ্ধতার কারণ নয়, বরং মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। প্রতি বর্ষা মৌসুমেই কারো না কারো জীবন থেমে যাচ্ছে এই উন্মুক্ত গহ্বরে। পথচলার মধ্যেই কখনো শিশু, কখনো বৃদ্ধ কিংবা শিক্ষার্থী হারিয়ে যাচ্ছেন।

নগরীর এসব খাল ও নালায় একের পর এক প্রাণহানি ঘটলেও বছরের পর বছর ধরে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। প্রতিবার দুর্ঘটনার পর আসে প্রতিশ্রুতি কিন্তু বাস্তব চিত্র পাল্টায় না। উল্টো ঘটনার পর দায়িত্বশীল বিভিন্ন সংস্থা একে অপরকে দোষারোপে ব্যস্ত থাকে।

নগরের খাল ও নালাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। অন্যদিকে, খাল সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। কিন্তু কোনো পক্ষই নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উন্মুক্ত খাল-নালার পাশে নেই কোনো সতর্কবার্তা, ব্যারিকেড বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বেশিরভাগ নালার পাশের সড়কগুলোতে নেই সড়কবাতি। সন্ধ্যা নামতেই অন্ধকার হয়ে যায় পুরো এলাকা। জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমানে চারটি প্রকল্প চলমান থাকলেও সেগুলো বাস্তবায়নের সময় জননিরাপত্তাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। তার ওপর দায়িত্বরত দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে কার্যকর সমন্বয়ের অভাব। সবমিলিয়ে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে এসব এলাকার পথচারীদের জীবন।

২০২১ সালের ২৫ আগস্ট মুরাদপুর মোড়ে সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ বৃষ্টির মধ্যে নালায় পড়ে নিখোঁজ হন। দীর্ঘদিন উদ্ধার অভিযান চালানো হলেও তার মরদেহ আর পাওয়া যায়নি। একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদ এলাকায় হাঁটার সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া উন্মুক্ত নালায় পড়ে মারা যান।

২০২২ সালে ষোলশহর এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় শিশু কামাল। তিন দিন পর মুরাদপুর থেকে উদ্ধার হয় তার নিথর দেহ।

২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট আগ্রাবাদ রঙ্গীপাড়ায় উন্মুক্ত নালায় পড়ে যায় ১৮ মাসের শিশু ইয়াছিন আরাফাত। ১৭ ঘণ্টার চেষ্টায় উদ্ধার হয় তার মরদেহ। আর ২০২৪ সালের জুনে গোসাইলডাঙ্গায় সাত বছরের শিশু সাইদুল ইসলাম নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। পরদিন পাওয়া যায় তার মরদেহ।

সবশেষ ঘটনা ঘটে শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) দিবাগত রাত ৮টার দিকে। চট্টগ্রাম নগরের কাপাসগোলা এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে ছিটকে পড়ে উন্মুক্ত নালায় পড়ে যান শিশুসহ তিনজন। তাদের মধ্যে দুই নারীকে স্থানীয়রা তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার করেন। তারা শিশুটির মা ও দাদি। কিন্তু তাদের সঙ্গে থাকা ছয় মাস বয়সী শিশু চেহরিস পানির স্রোতে তলিয়ে যায়। খবর পেয়ে প্রথমে ফায়ার সার্ভিস এবং পরে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও সিটি কর্পোরেশনের টিম রাতভর অভিযান পরিচালনা করে। শনিবার (১৯ এপ্রিল) সকালে ঘটনাস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে আসাদগঞ্জের চামড়া গুদাম মোড়ের পার্শ্ববর্তী চাক্তাই খাল থেকে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

চট্টগ্রাম নগরের খোলা খাল ও নালার অব্যবস্থাপনায় প্রাণহানির ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে– প্রশাসনের কোন সংস্থা এর জন্য দায়ী, চসিক নাকি সিডিএ? সংশ্লিষ্টরা জানান, দুই সংস্থারই ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে গাফিলতি রয়েছে। এক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির জন্য কোনো সংস্থাই পুরোপুরি দায় এড়াতে পারে না। ২০২১ সালে নালায় তলিয়ে মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে। তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান কমিটির প্রধান ছিলেন। তাদের তদন্তে উঠে আসে, নালায় তলিয়ে মৃত্যুর ঘটনায় দায় উভয় সংস্থার রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নগরের খাল, নালা ও ড্রেনগুলোর নিয়মিত পরিচর্যা, পরিষ্কার এবং উন্মুক্ত অবস্থায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অধিকাংশ নালা ও খাল দীর্ঘদিন ধরে খোলা পড়ে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নেই কোনো ব্যারিকেড, সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড কিংবা আলোর ব্যবস্থা।

অন্যদিকে, সিডিএ চট্টগ্রামের ড্রেনেজ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নগরের খাল ও নালাগুলোর সংস্কার ও সম্প্রসারণ কাজ করছে। এই প্রকল্পের আওতায় খাল খননের পর দীর্ঘদিন সেগুলো খোলা অবস্থায় ফেলে রাখা হচ্ছে। নেওয়া হচ্ছে না কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ মান রক্ষা করছে কি না, তা নজরদারির কার্যক্রমও নেই বললেই চলে। ফলে মানুষ প্রকল্পের সুফল পাওয়ার আগেই ঝুঁকির মুখে পড়ছে। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় জননিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার না দেওয়ার দায় পড়ে সিডিএর ঘাড়ে।

তাছাড়া দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবই সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে উঠে আসছে। দায়িত্ব ভাগাভাগির স্পষ্ট সীমারেখা না থাকায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এক পক্ষ অন্য পক্ষের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়। আর মাঝে ভুক্তভোগী হন সাধারণ মানুষ। তাই দ্রুত একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে ১৬ হাজার ৭৭১ কোটি টাকার চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পগুলোতে খাল পুনঃখনন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন, রেগুলেটর স্থাপন এবং সড়ক নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব প্রকল্পের আওতায় থাকা খাল-নালা দীর্ঘদিন ধরে উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে বছরের পর বছর বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহরের খাল পুনঃখনন এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন নামে একটি প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খাল পুনঃখনন ও সংস্কার করার কথা ছিল। এই প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে খাল উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে নানা সমস্যায় প্রকল্পটি এখনো শেষ করা যায়নি। অন্যদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপন ও ১৯ কিলোমিটার বন্যা প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের কাজ চলছে। তবে নানা কারণে এই প্রকল্পের কাজেরও যথাযথ অগ্রগতি হচ্ছে না।

কাপাসগোলা এলাকার বাসিন্দা সাহেনা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাসার সামনে যে খালটা আছে সেটি অন্তত দুই বছর ধরে খোলা। বর্ষাকালে পানি উপচে রাস্তায় চলে আসে, তখন আর বোঝা যায় না, কোথায় খাল আর কোথায় রাস্তা। শুক্রবার একটা রিকশা উল্টে মা ও দাদির সঙ্গে এক শিশু নালায় পড়ে যায়। মা ও দাদি উঠে এলেও শিশুটি তলিয়ে গিয়ে মারা যায়। এ ঘটনার পর থেকে ভয়ে আছি।

আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. মাহবুব ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোজ নানা কাজে নগরের অনেক রাস্তা ব্যবহার করতে হয়। যেগুলোর পাশে কোনো গার্ড রেল নেই, রাতে অন্ধকার থাকে। আমি নিজেই একবার পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম, ভাগ্য ভালো যে পাশে লোক ছিল। এরপর বৃষ্টির হলেই নালার পাশে থাকা সড়কে হাঁটতে ভয় লাগে।

বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা কুতুব উদ্দিন বলেন, আমি প্রতিদিন মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাই। রাস্তার পাশেই খোলা ড্রেন, যেখানে একটু পা পিছলে গেলেই বিপদ। সরকার যদি কোটি কোটি টাকা খরচ করে উন্নয়ন করতে পারে, সেখানে একটা ঢাকনা দিতে পারে না? আমরা উন্নয়ন চাই কিন্তু সেটা যেন জীবননাশী না হয়।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ৪-৫ বছর আগে থেকে প্রস্তাব দিয়ে আসছি খাল ও নালাগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এগুলো দুই ধরনের হয়ে থাকে। প্রথমত নালা বা খালের ওপর স্ল্যাব বসানো। দ্বিতীয়ত পাড়ে প্রাচীর দেওয়া। প্রধান খালগুলোতে ভৌগোলিক কারণে স্ল্যাব হয়ত বসানো যাবে না। কারণ চট্টগ্রামে নালার পানিতে পাহাড় ধুয়ে প্রচুর বালি চলে আসে। নিয়মিত পরিষ্কার করা সম্ভব না হলে বালিতে নালা পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। এজন্য আমরা প্রস্তাব করেছিলাম প্রাচীর দেওয়ার জন্য।

তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা। যে নালাগুলোতে জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্প চলমান রয়েছে এগুলোতে স্থায়ী কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তবে যেহেতু এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে নানা কারণে সময় লাগছে, সেহেতু নগর নিরাপদ রাখতে সাময়িক ব্যবস্থা নিতে হবে। এগুলো আমরা শুধু প্রস্তাব দিই, দুর্ঘটনার পর এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সোহাইব ঢাকা পোস্টকে বলেন, চসিক ও সিডিএ উন্মুক্ত খাল ও নালাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। খাল ও নালাগুলোর আশপাশে কোনো ব্যারিকেড, সতর্কীকরণ সাইন বা আলোর ব্যবস্থা নেই। দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও দায়িত্ব ভাগাভাগির স্পষ্ট সীমারেখা না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটলে একপক্ষ অন্য পক্ষের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়। দ্রুত একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি।

জানতে চাইলে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস ঢাকা পোস্টকে বলেন, একের পর এক মৃত্যুর পর গত তিন বছর আগে থেকে আমরা খাল পাড়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়ার কাজ শুরু করেছি। জলাবদ্ধতা নিরসনে ৩৬টি খাল আমাদের আওতায় রয়েছে। এর মধ্যে ২৩টিতে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলমান রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সবশেষ যে খালে শিশুটি তলিয়ে গেছে, সেটি আমাদের জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় ছিল। কিন্তু অর্থ সংকটে আমরা সেটিতে কাজ করতে পারিনি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে আমরা ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার আমাদের বলেছিল ৭৫০ কোটি দেবে এবং বাকি ৭৫০ কোটি টাকা সরকারের কাছ থেকে ৫ শতাংশ সুদে লোন নিতে। কিন্তু আমরা এই টাকা পাব কোথায়? এজন্য হিজরা খালে আমরা কাজ ধরতে পারিনি। সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের ৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এখন হিজরা খালে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে কাজ শুরু হবে। অলরেডি একদিক থেকে ভাঙা শুরু হয়েছে।

তবে এ বিষয়ে জানতে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

Facebook Comments Box
spot_img
এ বিভাগের আরও খবর
- Advertisment -spot_img

সর্বাধিক পঠিত খবর